৩. মল্লিকা ঝাঁঝি বা ওয়াটার হুইল
বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদগুলোর মধ্যে একটি হলো মল্লিকা ঝাঁঝি। একে অনেকে পাতা ঝাঁঝিও ডেকে থাকেন। বৈজ্ঞানিক নাম Aldrovanda vesiculosa Linn. এবং গোত্র Droseraceae।
ইটালিয়ান বোলঙ্গার বোটানিকাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা Ulisse Aldrovandi-এর নাম অনুসারে এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়। এটি একটি সপুষ্পক জলজ উদ্ভিদ। এটি মূলত ভারত, জাপান, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় দেখতে পাওয়া যায়। মল্লিকা ঝাঁঝি ১০-১৩ সেন্টিমিটার বা চার থেকে ১২ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। আকারে ছোট, শিকড়হীন । একে পুকুরে বা জলাশয়ে ভাসতে দেখা যায়। প্রত্যেকটি উদ্ভিদের কতগুলো স্বচ্ছ পাতাসহ একটি সরু কাণ্ড থাকে। কাণ্ডের চার দিকে আটটি পাতা চাকা স্পোকের মতো সাজানো থাকে বলে একে ইংরেজিতে Waterwheel বা জলের চাকা বলা হয়ে থাকে।
বসন্তকালে দুধের মতো সাদা ফুল ফোটে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মল্লিকা ঝাঁঝি পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালে রাজশাহীর পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত একটি বিল থেকে। পরবর্তীতে চলনবিল(পাবনা) থেকেও একবার সংগ্রহ করা হয়েছিল কিন্তু এর পর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো জায়গা থেকে মল্লিকা ঝাঁঝি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলাভূমির বসতি ধ্বংসের কারণে পরিবেশ থেকে এটি বিলুপ্তপ্রায়। তাই বিল অঞ্চলে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের Red Data Book (২০০১) এ উদ্ভিদকে বিপন্ন বলে চিহ্নিত করে। IUCN (২০১৩) এর তালিকায় এটি ৪৩টি দেশে পাওয়া যেত। এখন ২২টি দেশ থেকে এটি বিলুপ্ত। এ তালিকায় বাংলাদেশেও এটি বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
মল্লিকা ঝাঁঝির শিকার ধরার ফাঁদ পানির নিচে থাকে। প্রত্যেকটি উদ্ভিদের কতগুলো স্বচ্ছ পাতাসহ একটি সরু কান্ড থাকে। কান্ডের চারদিকে ৮ টি পাতা চাকা স্পোকের মত সাজানো থাকে বলে উদ্ভিদটিকে ওয়াটারহুইল বলা হয়। এ উদ্ভিদের পাতাগুলোই ফাঁদ হিসেবে কাজ করে। পাতাগুলো আকারে বেশ ছোট, দৈর্ঘ্যে মাত্র এক ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ (৬ মিলিমিটার)। আকারে খুব ছোট এদের শিকার গুলোও খুব ছোট হয়ে থাকে। এতে ধরা পড়ে উকুনের মত ছোট্ট এক ধরনের জলজ প্রাণী। প্ল্যাঙ্কটন নামে পরিচিত আণুবীক্ষণিক জলজ প্রাণীকুল আর জলজ প্রাণীদের লার্ভা। ওয়াটার হুইলের পাতাগুলো কাজ করে পানির নিচের ভেনাস ফাইট্র্যাপের মত। এদের পাতা দুটি খন্ডে বিভক্ত। এখানে সারিবদ্ধভাবে শুঙ্গ সাজানো থাকে। আর খন্ডগুলোর মধ্যে থাকে ট্রিগার হেয়ার। একটি পোকা ফাঁদে প্রবেশ করলে পাতার খন্ড দুটি এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ওয়াটারহুইল তখন শিকারকে পরিপাক করে ফেলে এবং পরবর্তী শিকার ধরার জন্য ফাঁদ আবারো প্রস্তুত হয়ে যায়।
০৪. ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ বা বুনো কীটকল
পৃথিবীর সব থেকে অদ্ভুদ ও ভয়ানক উদ্ভিদের নাম ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ। একে বাংলায় বলা হয় বুনো কীটকল। এর বোটানিক্যাল নাম Dionaea muscipula. বর্তমানে পৃথিবীতে এদের ৬টি বর্গের ৯টি গোত্রের মোট ৫৯৫টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সাধারণ উদ্ভিদ হতে ভিন্ন কিছু শারীরতত্ত্ব এবং বৈশিষ্ট্যময় অভিযোজনিক ক্ষমতার জন্য চার্লস রবার্ট ডারঊইন তাঁর ‘Insectivorous Plants’ নামক রচনায় একে ‘পৃথিবীর সবথেকে অদ্ভুত উদ্ভিদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এ উদ্ভিদটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনারজলাভূমিতে পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ একটি উদ্ভিদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ ফুট (৩০ সে.মি.)। বসন্তকালে এর লম্বা মাথার ওপর চমৎকার সাদা ফুল ফোটে। কিন্তু উদ্ভিদটির সবচেয়ে দর্শনীয় জিনিসটি হচ্ছে এর পাতা। ফাইট্র্যাপের সরু সবুজ পাতাগুলো উদ্ভিদটির গোড়ার চারপাশে জন্মে। প্রত্যেকটি পত্রফলক ঝিনুকের খোলসে মত দুইখন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেকটি খন্ডের মাঝখানে একটি মধ্যশিরা থাকে। খন্ড দুটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১ ইঞ্চি (২.৫ সে.মি.)। খন্ড দুটির ভেতরের তল সাধারণত লাল রঙের হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি খন্ডের চারপাশের বাইরের প্রান্তে অসংখ্য শক্ত, সূচালো শুঙ্গ থাকে। এগুলোকে বলা হয় সিলিয়া। প্রত্যেকটি খন্ডের ভেতরের দিকে তিনটি ট্রিগার হেয়ার থাকে।
সিলিয়ার ভেতরের ট্রিগার হেয়ারগুলোই উদ্ভিদের ফাঁদ। এগুলো দেখতে পাতার মত। পাতার খন্ড দুটি খোলা অবস্থায় ফাঁদটি শিকার করার জন্য তৈরি থাকে। উদাহরণস্বরূপঃ একটি মাকড়সা পাতার লাল রঙ আর পাতার কিনারায় থাকা মধুর মত মিষ্টি জিনিসটির প্রতি আকৃষ্ট হয়। মাকড়সাটি পাতার কিনারায় আসামাত্রই ট্রিগার হেয়ারগুলোতে টান পড়ে। তবে ফাঁদটি বন্ধ হওয়ার জন্য দুটি সঙ্কেতের প্রয়োজন। একটি ট্রিগার হেয়ার দু’বার স্পর্শ করলে ফাঁদটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। উদ্ভিটটি বুঝতে পারে যে, কোন ঘাস বা পাতার টুকরো নয় বরং কোন জ্যান্ত প্রাণী ফাঁদে আটকা পড়েছে। দু’বার সংকেত পেলেই পাতার খন্ড দুটি খুব দ্রুত মাকড়সাটির চারপাশে এসে বন্ধ হয়ে যায়। সিলিয়াগুলো একসাথে বন্ধ হয়ে পালানোর পথও বন্ধ করে দেয়। এ পর্যায়ে খুব ছোট্ট একটি মাকড়সা কিংবা পোকামাকড় সিলিয়ার ভেতর দিয়ে ঢুকে যেতে পারে। উদ্ভিদটি এ ধরনের পোকামাকড়পকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়। ফাঁদের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পরই পাতার ভেতর থেকে এক ধরনের তরল পদার্থ বেরিয়ে আসে। তরলের মধ্যে মাকড়সাটি ডুবে যায়। এ তরল পদার্থের মধ্যে থাকে পরিপাকে সাহায্যকারী উৎসেচক। এগুলো মাকড়সার দেহটিকে এমন অবস্থাতে পরিণত করে ফেলে যা থেকে উদ্ভিটটি সহজেই পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করতে পারে। উৎসেচক যত বেশি পারিমাণে আসে মাকড়সার মৃতদেহের নরম অংশগুলোও ততই ধীরে ধীরে গলতে থাকে। ৮/১০ দিন পর মাকড়সাটির দেহের অংশগুলো নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ তরল পদার্থে পরিণত হয় যা উদ্ভিদ দ্বারা শোষিত হয়ে যায়। মৃতদেহের যেসব শক্ত অংশগুলো উদ্ভিদটি হজম করতে পারেনি সেগুলো ফাঁদটি খুলে বের করে দেয়। ফাঁদ আবার আগের মত পেতে রাখা হয়। নষ্ট হয়ে যাবার আগে একটি ফাঁদ অন্তত তিনবার শিকার ধরে ফাইট্র্যাপ গাছকে সহায়তা করে।
বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-১)
বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-২)
আমার আরও কিছু লিখা, ইচ্ছে হলে পড়তে পারেন। আশা করছি,ভালো লাগবে।
০১. ভুতের গাছ ছাতিম
০২. ল্যান্টেনা ফুল || প্রজাপতিরা যে ফুলে নেচে বেড়ায়
০৩. হিজল গাছ || এমনই-হিজল-বট-তমালের নীল ছায়ায় বাংলার অপরুপ রুপ

এমনই সুন্দর এবং রহস্যময় প্রানী এবং পাখিদের জগত।