বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দূর্যোগগুলোর মধ্যে বন্যা অন্যতম। এই ভয়াবহ বন্যা প্রায় প্রতি বছরই এদেশের মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গৃহপালিত পশুপাখি ধ্বংস করে দেয় এবং অনেক মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। যারা বেঁচে থাকেন তাদের জীবনেও নেমে আসে ভয়াবহ কালােরাত্রি। প্রতিবছরের ন্যায় কিছুদিন আগে এবছরও বন্যা দেখিয়েছে তার ভয়াবহতা। এ বছরের বন্যায় প্রায় ৩৫ লাখের বেশি মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছিল। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি জেলার সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বর্ষাতেই বন্যার এধরনের ভয়াবহতা দেখতে পাওয়া যায়।
বন্যার তীব্রতা ও ভয়াবহতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটা স্পষ্ট যে, আমাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেজন্য আমাদের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও প্রাকৃতিক বন্যা ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। প্রাকৃতিক বন্যা ব্যবস্থাপনা হল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে বন্যার ঝুঁকি কমানো। উদাহরণস্বরুপঃ- নদীর বাঁক পুনরুদ্ধার করা, নদীর নাব্যতা রক্ষা করা, পুকুর-ডোবা, খাল-বিলসহ অন্যান্য জলাশয় রক্ষা করা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উদ্ভিদ রোপণ করা।
মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হল উদ্ভিদ। নানাবিধ উপকারের পাশাপাশি উদ্ভিদ বন্যা প্রতিরোধেও সহায়তা করে। ইউনাইটেড স্টেইট ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) এর মতে, “সাধারণ মাঝারি আকারের একটি উদ্ভিদ প্রতি বছর প্রায় ২৩৮০ গ্যালন বৃষ্টিপাতকে আটকাতে পারে।”
উদ্ভিদ যেভাবে বন্যা প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারেঃ-
মাটি ক্ষয় কমানোর মাধ্যমেঃ- উদ্ভিদের শিকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে। ফলে ভারী বৃষ্টিপাতেও মাটি ক্ষয় হয় না। এমনকি উদ্ভিদের পাতাও মাটির ক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করে। যখন বৃষ্টির ফোঁটা পাতায় পড়ে, তখন মাটি ক্ষয় অনেকাংশেই কমে যায়। উদ্ভিদ না থাকলে এসব মাটি ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে স্রোতের সাথে প্রবাহিত হয়ে নদী ও জলাশয়গুলোর তলদেশ ভরাট করে দেয়। ফলে এসব জলাশয়ের পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং বৃষ্টিপাত হলে বন্যা হয়।
মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমেঃ- উদ্ভিদের শিকড় পানিকে মাটিতে দ্রুত এবং আরও গভীরভাবে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। উদ্ভিদের শিকড় মাটিতে চ্যানেল তৈরি করে যা ‘ম্যাক্রোপোরস’ নামে পরিচিত এবং ভারী বৃষ্টির পানি ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পরিবর্তে এই চ্যানেলগুলো ব্যবহার করে মাটিতে অনুপ্রবেশ করে। ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উপর চাপ কমে যায়।
সালোকসংশ্লেষণে পানি ব্যবহারের মাধ্যমেঃ- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকল জীবের খাদ্যের মূল উৎস হল উদ্ভিদ। এটি মাটি থেকে পানি শোষণ করে এবং সূর্যের আলোর উপস্তিতিতে কার্বনডাইঅক্সাইডের মাধ্যমে পাতায় অবস্থিত ক্লোরোফিলের সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা জাতীয় খাদ্য প্রস্তত করে। প্রস্বেদনের মাধ্যমে মূলরোম থেকে পানি ও অন্যান্য খনিজ উপাদান পাতায় টেনে নেয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রচুর পানি বাষ্পীভূত হয়। ফলে গ্রামাঞ্চলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উপর চাপ কমে যায় এবং বন্যার ভয়াবহতা হ্রাস পায়।
পানির স্রোতের তীব্রতা হ্রাসের মাধ্যমেঃ স্রোতের ধারে এবং প্লাবনভূমিতে গাছ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদসমূহ পানিকে আটকে রাখে এবং ভারী বৃষ্টিপাতের সময় পানি প্রবাহকে ধীর করে দেয়। ফলে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি পানির তীব্রস্রোত থেকে রক্ষা পায়। এতে বন্যার ধ্বংসলীলা অনেকাংশেই হ্রাস পায়।
এবিষয়ে, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সাইমন ডিক্সন বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি যে, উদ্ভিদ রোপণ বন্যার ঝুঁকি কমাতে একটি বড় অবদান রাখতে পারে এবং এটি প্রচলিত বন্যার প্রতিরক্ষাসহ ব্যাপক বন্যা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির অংশ হওয়া উচিত।” যেহেতু উদ্ভিদ বন্যা হ্রাসের জন্য সুস্পষ্ট ভূমিকা প্রদান করে এবং অন্যান্য ইকোসিস্টেম পরিষেবাও প্রদান করে, তাই আমাদের সকলের উচিত বেশি বেশি উদ্ভিদ রোপণ করা। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি এবং ব্যক্তিগতভাবে উদ্ভিদ রোপণের প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের প্রাকৃতিক বন্যা ব্যবস্থাপনায় এবং উদ্ভিদ রোপণে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। মোটকথা, দেশের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে আমাদের বেশি বেশি উদ্ভিদ লাগাতে হবে এবং উদ্ভিদ রােপণ কর্মসূচি পালন করতে হবে।