‘থানকুনি’ বাংলাদেশের খুবই পরিচিত একটি ভেষজ উদ্ভিদের নাম। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত উদ্ভিদও এটি। ইংরেজিতে একে বলা হয় Indian pennywort. এটি Apiales বর্গের Mackinlayaceae ফ্যামিলির একটি উদ্ভিদ যার বোটানিক্যাল নাম Centella asiatica.
অঞ্চলভেদে থানকুনি পাতাকে টেয়া, মানকি, তিতুরা, থানকুনি, আদামনি, ঢোলামানি, থুলকুড়ি, মানামানি, ধূলাবেগুন, আদাগুনগুনি ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।

বাংলাদেশ, ভারত, সিংহল, উত্তর অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, এবং এশিয়ার অন্যান্য প্রান্তে এই উদ্ভিদ পাওয়া যায়। ভেষজ হিসাবে এর বহুল ব্যবহার আছে আয়ুর্বেদিক, প্রাচীন আফ্রিকীয়, চৈনিকসহ অনেক দেশের চিকিৎসাবিদ্যায়। বাংলাদেশেও এর সুনাম সুদুরপ্রসারি। থানকুনি পাতা এদেশের সব জায়গায় পাওয়া যায়। বহু রোগের  উপশম হয় এই ভেষজ উদ্ভিদটির কল্যাণে। খাদ্য হিসাবে এই পাতা সরাসরি খেলে রোগ নিরাময়ে যথার্থ  ভূমিকা রাখতে পারে।

থানকুনি পাতার রোগ নিরাময় ক্ষমতার উপর এদেশের মানুষের আস্থা সুপ্রাচীন। বহুকাল ধরে এদেশের মানুষ থানকুনি পাতাকে মহা ঔষধ রুপে ব্যবহার করে আসছে। সেজন্যই বোধ হয়, করোনার মতো ভয়াবহ মহামারীর ঔষধ হিসেবেও মানুষ একে গ্রহণ করতে চেয়েছিল। কোনো এক পীর স্বপ্নে দেখেছেন ৩টি করে থানকুনিপাতা খেলে করোনা সারবে। আর সেই গুজবে কান দিয়ে গভীর রাতে স্বজনরা দূরে থাকা স্বজনদের ফোন করে বিষয়টি জানান। এভাবেই দেশে রোটে যায়, থানকুনি পাতা খেলে করোনা সারে। যদিও বাস্তবে থানকুনি পাতা করোনা নিরাময়ে কোনো ভুমিকা রাখে না। তবে থানকুনি পাতার ঔষধি গুণাবলির উপর দেশের মানুষের আস্থা কতখানি, এই ছোট বিষয়টি থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায়।

খ্রিষ্টপূর্ব সেই ১৭ শতক থেকে আফ্রিকা, জাভা, সুমাত্রা, ফ্রান্স, শ্রীলঙ্কা এবং ফিলিপিন্সে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে থানকুনি পাতা। কারণ, একজিমা এবং সোরিয়াসিসের মতো জটিল ত্বকের রোগ সারিয়ে তুলতে যেমন এই প্রাকৃতিক উপাদানটির জুড়ি মেলা ভার, তেমনি এই গুল্মটিতে উপস্থিত একাধিক উপকারী খনিজ এবং ভিটামিন মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ায়। শরীরের দেখভালেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। থানকুনি পাতার এরকমই ২০টি ঔষধি গুণাবলি নিম্নে দেওয়া হলোঃ

১. শরীরে হজম শক্তি কম হলে,থানকুনি পাতা খাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পেঁপের সাথে থানকুনি পাতা মিশিয়ে রান্না করে এক মাস খেতে হবে।এতে দেহের হজম শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

২. আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময় তাপমাত্রার ওঠা-নামা করার কারণে অনেকেই জ্বরের খপ্পরে পড়েন। তখন থানকুনি পাতা খেতে ভুলবেন না যেন। সকালে খালি পেটে এক চামচ থানকুনি পাতার রসের সঙ্গে ১ চামচ শিউলি পাতার রস মিশিয়ে খেলে জ্বরের প্রকোপ কমতে সময় লাগে না। এমনকী, সর্দি-কাশির মতো সমস্য়াও কমে অল্প দিনে।

৩. অল্প পরিমাণ আম গাছের ছাল, আনারসের কচি পাতা ১টি, কাঁচা হলুদের রস, ৪/৫ টি থানকুনি গাছের শিকড়সহ ভালো করে ধুয়ে একত্রে বেটে রস করে খালি পেটে খেলে পেটের অসুখ ভালো হয়। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি কার্যকর।

৪. গ্যাস্ট্রিক নিত সমস্যায় ভুগলে থানকুনি পাতা খেতে পারেন। মহা ঔষধ রুপে কাজ করবে। আধা কেজি দুধে ২৫০ গ্রাম মিশ্রি ও ১৭৫ গ্রাম থানকুনি পাতার রস একত্রে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ১ সপ্তাহ খেলে গ্যাস্ট্রিক ভালো হয়।

৫. খুসখুসে কাশি হলে থানকনি পাতা খেতে পারেন। ২ চামচ থানকুনির রস সামান্য চিনিসহ খেলে সঙ্গে সঙ্গে খুসখুসে কাশিতে উপকার পাওয়া যায়। ১ সপ্তাহ খেলে পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে।

৬. প্রতিদিন সকালে খালিপেটে ৪ চা চামচ থানকুনি পাতার রস ও ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে ৭ দিন খেলে রক্তদূষণ দূর হয়। এতে অনেক জটিল রোগের উপশম হবে।

৭. যেসব বাচ্চা কথা বলতে দেরি করে অথবা অস্পষ্ট, সে ক্ষেত্রে ১ চামচ করে থানকুনি পাতার রস গরম করে ঠাণ্ডা হলে ২০/২৫ ফোঁটা মধু মিশিয়ে ঠাণ্ডা দুধের সাথে কিছুদিন খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়।

৮. প্রতিদিন সকালে ৫/৭টি থানকুনি পাতা চিবিয়ে ৭ দিন খেলে আমাশয় ভালো হয়। থানকুনি পাতা বেটে পাতার রসের সাথে চিনি মিশিয়ে দুই চামচ দিনে দুই বার খেলে আমাশয় ভালো হয়।

৯. থানকুনি পাতা বেটে গরম ভাতের সাথে খেলে পেটব্যথা ভালো হয়।

১০. প্রতিদিন সকালে থানকুনির রস ১ চামচ, ৫/৬ ফোঁটা হলুদের রস সামান্য চিনি ও মধুসহ ১ মাস খেলে লিভারের সমস্যা ভালো হয়।

১১. যদি মুখ মলিন হয়, লাবণ্যতা কমে যায় তবে ৫-৬ চা চামচ থানকুনি পাতার রস দুধ দিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত করলে উপকার পাবেন।

১২. কোথাও থেঁতলে গেলে থানকুনি গাছ বেটে অল্প গরম করে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে প্রলেপ দিলে উপকার পাবেন।

১৩. থানকুনি পাতা বেটে ঘিয়ের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে ঠাণ্ডা করে তা ক্ষত স্থানে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।

১৪. অপুষ্টি ও ভিটামিনের অভাবে চুল পড়ে গেলে পুষ্টিকর ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ৫-৬ চা চামচ থানকুনি পাতার রস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে।

১৬. মলের সঙ্গে শ্লেষ্মা গেলে, মল পরিষ্কারভাবে না হলে, পেটে গ্যাস হলে, কোনো কোনো সময় মাথা ধরা এসব ক্ষেত্রে ৩-৪ চা চামচ থানকুনি পাতার গরম রস ও সমপরিমাণ গরুর কাঁচা দুধ মিশিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত খেলে উপকার পাবেন।

১৭. ঠাণ্ডায় নাক বন্ধ হলে, সর্দি হলে থানকুনির শিকড় ও ডাটার মিহি গুঁড়ার নস্যি নিলে উপকার পাওয়া যায়।

১৮. নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়া শুরু করলে শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং Pentacyclic Triterpenes নামক একটি উপাদানের মাত্রা বাড়তে শুরু করে, যে কারণে ব্রেন সেলের ক্ষমতা এতটাই বেড়ে যায় যে স্মৃতিশক্তির উন্নতি তো ঘটেই, সেই সঙ্গে বুদ্ধির ধারও বাড়ে চোখে পড়ার মতো। এই কারণেই তো ছোট বাচ্চাদের থানকুনি পাতার রস খাওয়ানোর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। বয়স্ক মানুষরাও যদি নিয়মিত থানকুনি পাতার রস খান, তা হলে শেষ বয়সে অ্যালঝাইমার্স বা ডিমেনশিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে।

১৯. রাতে কি ঠিক মতো ঘুম না হলে আজ থেকেই খাওয়া শুরু করুন থানকুনি পাতা।উপকার মিলবে একেবারে হাতে-নাতে। কারণ, এতে রয়েছে একাধিক অ্যান্টিঅক্সিডান্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান, যা স্ট্রেস লেভেল কমায়। সঙ্গে নার্ভাস সিস্টেমকে শান্ত রাখে। ফলে অনিদ্রার মতো সমস্যা দূরে পালাতে সময় লাগে না।

২০. নানা ভাবে আমাদের শরীরে প্রবেশ করা টক্সিক উপাদানদের যদি সময় থাকতে-থাকতে বের করে দেওয়া না যায়, তা হলে কিন্তু চিন্তার বিষয়। কারণ, সেক্ষেত্রে এই সব ক্ষতিকর উপাদানগুলির কারণে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এখন প্রশ্ন হল, টক্সিক উপাদানদের শরীর থেকে বের করবেন কীভাবে? এক্ষেত্রে ভরসা রাখতে পারেন, থানকুনি পাতার উপরে। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠা মাত্র ২ চামচ থানকুনি পাতার রসের সঙ্গে যদি ১ চামচ মধু মিশিয়ে খাওয়া যায়, তা হলে রক্তে মিশে থাকা টক্সিক উপাদানগুলি প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। ফলে শরীরের কোনও ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আর থাকে না।

আমার আরও কিছু লিখাঃ

০১. ভুতের গাছ ছাতিম
০২. ল্যান্টেনা ফুল || প্রজাপতিরা যে ফুলে নেচে বেড়ায়
০৩. হিজল গাছ || এমনই-হিজল-বট-তমালের নীল ছায়ায় বাংলার অপরুপ রুপ

বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-১)

বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-২)

বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-৩)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here