চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যেই প্রজাতির ড্রসেরা পাওয়া যায় সেগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম Drosera Burmannii . এটি গ্রীষ্মমন্ডলীয়, একটি ছোট এবং কমপ্যাক্ট প্রজাতি। এটি ভৌগলিকভাবে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, তাইওয়ান, চীন, জাপান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়। সাধারণত এর ব্যাস 2 মিমি (0.8 ইঞ্চি) বিস্তৃত হয়। এটি সানডিউজের সবচেয়ে দ্রুততম শিকারী প্রজাতিগুলোর একটি। ড্রসেরা বুরমান্নি আয়ুর্বেদে এক শক্তিশালী রুবেফেসিয়েন্ট (rubefacient) হিসাবে বিবেচিত। এর পাতাগুলো ছোট এবং গোলাকার। গ্রীষ্মকালে সাদা ফুল ফোটে। সানডিউজের পাতাগুলোকে উজ্জ্বল লাল রঙের দেখায়। মনে হয় ওগুলোর উপর শিশির কণা চিকচিক করছে।

লালচে শিশির বিন্দু দ্বারা আবৃত এ পাতাগুলো আসলে পোকামাকড় ধরার মরণ ফাঁদ। সূর্যশিশিরের পাতাগুলো বিভিন্ন উচ্চতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য বোঁটা দিয়ে ঢাকা থাকে। প্রত্যেকটি বোঁটার ওপর থাকে অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রন্থি বা অঙ্গ যা এক ধরনের স্বচ্ছ আঠালো তরল পদার্থ উৎপন্ন করে। এ তরল পদার্থটি বোঁটাগুলোর ওপর শিশির বিন্দুর মত জমা হয়। তরল নিঃসরণকারী গ্রন্থিটি দেখতে লাল বলে এর ওপরের তরল পদার্থটিও লালচে বলে মনে হয়। সূর্যশিশির এক ধরনের সুগন্ধও বাতাসে ছড়ায়। মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় উজ্জ্বল লাল রঙ, শিশির বিন্দু আর সুগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে উদ্ভিদের কাছে চলে আসে। কিন্তু পোকা গাছটির পাতার ওপর নামা মাত্রই পোকার পাগুলো পাতার উঁচু বোঁটায় থাকা তরল পদার্থে আটকে যায়। পা ছাড়িয়ে নিতে ওরা যতই টানাটানি করে ততই পাতার গ্রন্থিগুলো থেকে আরো বেশি করে আঠালো রস বের হতে থাকে। এভাবে পোকামাকড়গুলো আরো শক্তভাবে পাতায় আটকে যায়। পোকার চারপাশে থাকা বোঁটাগুলো বেঁকে গিয়ে আরো বেশি পরিমাণে রস বের করতে থাকে। সম্পূর্ণ পাতাটি কুঁচকে গিয়ে পোকাটির চারপাশে একটি পেয়ালার মত আকার গঠন করে। পোকাটির দেহের নরম অংশগুলো গলে গিয়ে পাতায় মিশে না যাওয়া পর্যন্ত সানডিউজ উদ্ভিদের পরিপাকে সাহায্যকারী এনজাইমগুলো কাজ করে। ৪-৫ দিন পর সূর্যশিশিরের পাতা ও বোঁটাগুলো আবার আগের মত সোজা হয়ে যায়।

০২. কলসি উদ্ভিদ
Nepenthaceaeএবং Sarraceniaceae পরিবারের অন্তুর্ভুক্ত সবচেয়ে ভয়ংকর মাংসাশী উদ্ভিদের নাম Pitcher plants বা কলসি উদ্ভিদ। এদের মালয়েশিয়া, মাদাগাস্কার, ভারত ও শ্রীলংকারগ্রীষ্মমন্ডলীয় জলাভূমিতে দেখতে পাওয়া যায়। এরা এক প্রকার মাংসাশী উদ্ভিদ যাদের পরিবর্তিত পাতাগুলো একধরনের ফাঁদ হিসেবে কাজ করে । পাতাগুলো দেখতে কলসির মতো। পাতাগুলোর গভীর গহ্বরটি তরলদ্বারা পূর্ণ থাকে। কলসির মতো গঠন ও আকৃতির জন্যই এদেরকে কলসি উদ্ভিদ নামে ডাকা হয়।

নেপেনথাসি পরিবারের কলসি উদ্ভিদের একটি প্রজাতি হলো খাসি কলসি উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nepenthes khasiana. এটি বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী সংরক্ষিত প্রজাতি। উক্ত আইনের শেষে যুক্ত ৪র্থ তফসিলে মোট ৫৪টি উদ্ভিদের নামোল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে সংরক্ষিত উদ্ভিদ (Protected plants) হিসেবে বিবেচিত হবে। সংরক্ষিত ঘোাষিত উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সকলকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা উক্ত আইনের ৬ ধারা মোতাবেক এই ৫৪ প্রজাতির উদ্ভিদ ইচ্ছাকৃতভাবে উঠানো, উপড়ানো, ধ্বংস বা সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উক্ত ধারা লঙ্ঘন করলে বিচারক্রমে ৩৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। কোন ব্যক্তি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে।

গ্রীষ্মমন্ডলীয় কলসি উদ্ভিদে সাধারণ পাতা এবং উজ্জ্বল রঙের কলসির মত পাতা দুটোই রয়েছে। একটি আকর্ষী থেকে ধীরে ধীরে সুতোর মত একটি পাতা উৎপন্ন হয়। পাতাটি বড় হতে হতে ফুলে উঠে রঙিন একটি জগের মত আকৃতি লাভ করে। এর ওপরের দিকে পাতার তৈরি একটি ঢাকনাও তৈরি হয়। কোন কোন কলসি উদ্ভিদে ঢাকনাটি কলসির কিনারে শোভাবর্ধক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন প্রজাতির কলসি উদ্ভিদের পাতাগুলোর আকার, রঙ ও আকৃতি ভিন্ন হতে পারে। এগুলোর দৈর্ঘ্য মাত্র ২ ইঞ্চি (৫ সে.মি.) থেকে শুরু করে ২ ফুট (৬০ সে.মি.) পর্যন্ত হতে পারে।

ছোট ছোট কলসি উদ্ভিদগুলো মাছি, গুবরে পোকা, পিঁপড়া ইত্যাদি পোকামাকড় শিকার করে। বড় আকারের কলসি উদ্ভিদগুলো ছোট আকারের ব্যাঙ কিংবা ইঁদুর শিকার করে। কিন্তু সব কলসি উদ্ভিদই এক পদ্ধতিতে শিকার করে। কলসি উদ্ভিদের ফাঁদ পরোক্ষ ধরনের। অর্থাৎ এরা কোন নাড়াচাড়া ছাড়াই শিকার ধরে থাকে। কলসি উদ্ভিদের গঠন এমন যে এর ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া পোকামাকড়দের জন্য এটি বন্দিশালার মত কাজ করে। কলসের সঙ্গে আটকানো পাতাটি লম্বা নলের মত কাজ করে। নলের মাথায় থাকে রঙচঙে একটি প্রবেশ পথ। নলের তলদেশ অংশটি পেয়ালাকৃতির। যেসব কলসি উদ্ভিদ মাটির কাছাকাছি জন্মে তাদের মধ্যে বৃষ্টির পানি জমা হয়ে থাকে। অধিকাংশ কলসি উদ্ভিদের ঢাকনাটি প্রবেশ পথ দিয়ে বেশি পরিমাণে বৃষ্টির পানি ঢুকতে বাধা দেয়। ঢাকনাটি সবসময় খোলা থাকে। কলসির প্রবেশ মুখে এক ধরনের মধু উৎপন্ন হয়। কলসির উজ্জ্বল রঙ আর মধুর লোভে আকৃষ্ট হয়ে পোকামাকড় ওড়ে কিংবা হামাগুড়ি দিয়ে কলসির ভিতরে প্রবেশ করে। ভেতরেই ঢুকে এটি মধু উৎপন্ন করে এবং আরো মধুর লোভে কলসির আরো ভিতরে ঢুকে যায়। পোকাটি কলসির নলের ভিতরেই ঢোকার পরই বিপদে পড়ে যায়। নলের ভিতরের দেয়ালটি বরফের মতই মসৃণ আর পিচ্ছিল। ফলে পোকাটি পিছলে গিয়ে নলের আরো তলের দিকে পড়ে যায়। নলের তলদেশে থাকে অসংখ্য শুঙ্গ। শুঙ্গগুলো সবই কলসির নিচে জমানো পানির দিকে ফেরানো থাকে। এগুলো পার হয়ে পোকাটি নিচে পড়ে গেলে তার পক্ষে আর আর ওপরের দিকে ওঠা সম্ভব হয়না। একসময় এটি তলদেশের পানিতে ডুবে যায়। এরপর পরিপাকে সাহায্যকারী উৎসেচকগুলো কলসির তলদেশে বেরিয়ে আসে। পোকাটির দেহের নরম অংশগুলো পরিপাক হয়ে উদ্ভিদের দেহে শোষিত হয়। শক্ত অংশগুলো কলসির নিচের তলদেশে জমা হয়।

(লিখাটি বড় হয়ে যাওয়ায় পড়ার সুবিধার্থে পর্ব আকারে আপলোড দিচ্ছি। মাংসাশী পতঙ্গভুক উদ্ভিদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে গত পর্ব দেখে আসতে পারেন। আগামী পর্বে আরও কিছু অদ্ভুদ উদ্ভিদ নিয়ে লিখবো। কেমন হচ্ছে কমেন্টে জানাবেন। ধন্যবাদ।)

বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-১)

বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-২)

আমার আরও কিছু লিখা, ইচ্ছে হলে পড়তে পারেন। আশা করছি,ভালো লাগবে।
১. ভুতের গাছ ছাতিম
০২. ল্যান্টেনা ফুল || প্রজাপতিরা যে ফুলে নেচে বেড়ায়
০৩. হিজল গাছ || এমনই-হিজল-বট-তমালের নীল ছায়ায় বাংলার অপরুপ রুপ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here