ভুত মানে ভয়, ভুত মানে বিদঘুটে। আদিকাল থেকেই মানুষ ভুতে ভয় পেয়ে আসছে। মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। অবাক হতে চায়। যা বাস্তব নয় সে সব বিষয় বিশ্বাস করতে চায়। ভুতও তেমনই এক বিশ্বাস। ভুতপ্রেমীদের কাছে ছাতিম অতি পরিচিত এক গাছ। ছোট বেলায় দাদী-নানীদের কাছে ছাতিম গাছের ভুতের গল্প কে না শুনেছে?

“শ্যাওড়া গাছে পেতনী ঠাসা, ছাতিম গাছে ভূতের বাসা।”

Apocynaceae বর্গের অন্তর্ভুক্ত এই গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia scholaris. ইংরেজিতে একে Devil’s tree অর্থাৎ ভুতের গাছ বলা হয়ে থাকে। কারণ রাত একটু গভীর হলে মনে হয় যেন কোন এক দানব জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর রাতে এই গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় গা ছমছম করে।সেজন্য এ গাছকে ঘিরে সারা বিশ্বজুড়ে নানা গুজব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এ গাছে নাকি ভূত থাকে।  তাই একে ইংরেজিতে ডাকা হয় ‘ডেভিলস ট্রি’।

এ গাছ ৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছটি বহু শাখা বিশিষ্ট। এর ছাল গন্ধহীন, অসমতল ও ধুসর। এর শাখা পত্রমূলাবর্ত বিশিষ্ট। একই মূলাবর্তে ৪-৭টা পর্যন্ত পাতা থাকে। পাতাগুলো ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। চওড়া হয় ২-৪ সেন্টিমিটার। ছাতিম পাতা চামড়ার মতো পুরু। এর বোঁটা 0.25-0.60 সেন্টিমিটার হয়। ছাতিমের বীজ লম্বাটে ডিম্বাকার, কিনারায় আঁশ থাকে আর শেষ প্রান্তে এক গোছা চুল থাকে। ছাতিম গাছের অভ্যন্তরে দুধের মত সাদা এবং অত্যন্ত তেতো কষ থাকে। গাছটির ছাল কাটলে,সেখান থেকে দুধের মত কষ বের হয়। সেই কষ অদ্ভুত সুন্দর।

Image Source: Wikipedia

এর আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ক্রান্তীয় অঞ্চলের এই গাছটি বাংলাদেশসহভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র জন্মে। আর্দ্র, কর্দমাক্ত, জলসিক্ত স্থানে ছাতিম বেশি জন্মে। ছাতিম মূলাবর্তে সাতটি পাতা এক সঙ্গে থাকে বলে সংস্কৃত ভাষায় একে ‘সপ্তপর্ণ’ বা ‘সপ্তপর্ণা’ নামে ডাকা হয়। ছাতিমগাছ হল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উদ্ভিদ।

আমরা গত ১১ই মার্চ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চুন্যতি বন্যজীব অভয়ারণ্যে গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার পথে এ গাছ দেখেছি। গাছটি সম্পর্কে যাতে আমাদের মনে থাকে সেজন্য স্যার একটু ঠাট্টার ছলে বলেন, “পূর্বে  অনেক গাঁধারা  এই গাছের নিচে বসে পড়াশুনা করে জ্ঞানী হয়েছে। তাই এর নাম হয়েছে স্কলারিস।” স্যারের কাছ থেকে এমন কথা শুনে এই গাছ  সম্পর্কে জানার আগ্রহ বহুগুনে বেড়ে গিয়েছিল।

ছাতিম পাতা

ছাতিম গাছের সাথে ছাতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাই ছাতিমতলা ছায়াময় । ঘন ছায়ার জন্য সাধু সন্ন্যাসী ও মুণি ঋষিরা ধ্যানে বসতেন ছাতিম গাছের তলায়।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের ছাতিমগাছের নিচে পঠন পাঠন হতো,বিদ্যা চর্চা হতো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি নিকেতনে সমাবর্তনের সময় প্রথম উপহার দিতেন ছাতিম পাতা। Scholar মানে wiseman, talent. যেহেতু স্কলাররা এই গাছের নিচে বসতেন,তাই এই গাছের নাম হয়েছে scholaris. 

স্কুল কলেজের শ্রেণীকক্ষে ব্ল্যাক বোর্ডের ওপর সাদা চক পেন্সিলে লিখা হয়। সেই ব্ল্যাক বোর্ড তৈরি হয় ছাতিম কাঠ দিয়ে। ছাতিমের কাঠ হালকা ও মসৃণ। কাঠ পেন্সিল তৈরিতেও ব্যবহার হয় ছাতিম কাঠ।  সেজন্য ইংরেজিতে একে “Blackboard  Tree” ও বলায় হয়ে থাকে।

ছাতিমের ফুল ফোটা শুরু হয় হেমন্তে। হেমন্তের প্রকৃতি ছাতিমের ফুলে ফুলে শুভাষিত হয়ে ওঠে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ছাতিম ফুলের আভা। সেই সাথে ছাতিম ফুল জানান দিয়ে যায় নবান্ন আসছে, আসছে শীত। পিঠাপুলি খাওয়ার দিন আসছে। শীতে গাছের সব প্রশাখা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ছাতিমের ফুলও সবুজাভ। ফুলের নিচের অংশ নলের মতো। ওপরের অংশে পাঁচটি পাপড়ি সামন্য বাঁকানো। পরাগ কেশ ও গর্ভ কেশ পরস্পর সংযুক্ত। ফলে তীব্র মধুগন্ধ হাওয়ায় ভেসে যায় দূর-বহুদূর। প্রায় দুর্লভ দর্শন হয়ে পড়ে অসাধারণ সুন্দর ছাতিম তরু।

Image source : Wikipedia

ছাতিমের কষ দেখতে দুধের মতো। গাছের বাকল কাটলে কষ বের হয়। অনেকে এই কষ ঔষুধরূপে ঘা বা ক্ষতে লাগিয়ে থাকেন। ছাতিমের ছাল এবং কষ জ্বর, হাঁপানি ও কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় বহুকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । ছাতিম গাছের বাকল বা ছাল শুকিয়ে নিয়ে ঔষুধের কাজে ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘস্থায়ী অতিসার এবং আমাশয়ে এটি অত্যন্ত উপকারী।

ছাতিমের কাঠ দিয়ে খুব সাধারণ মানের আসবাবপত্র, প্যাকিং কেস,  পেনসিল এবং দিয়াশলাইয়ের কাঠি তৈরি হয়। একসময় ছাতিমের কাঠ দিয়ে শিশুদের লেখার জন্য চিলেট বানানো হত। তাতে শিশুরা চক দিয়ে লিখতো। এছাড়াও ছাতিমের হালকা কাঠ দিয়ে কফিন, চায়ের পেটি ইত্যাদি বানানো যায়।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here