দিনের আলো নিভে সন্ধ্যা নেমে আসে, তবু ব্যস্ততা থামে না। মানুষের ছুটে চলা থামে না যান্ত্রিক পৃথিবীতে। কিছুদিন আগেও উন্মাদের মতো ছুটে চলছিল মানুষের কর্মযজ্ঞ আর জীবনযাত্রা। নিজেদের প্রয়োজনে আমরা ভুলেই গিয়েছি, প্রকৃতি কিংবা পরিবেশের চাহিদা। আমরা ভুলে গিয়েছি, প্রকৃতির নিরবতা। Revenges of Nature বলে যে একটি কথা আছে,আমরা ভূলেই গিয়েছিলাম। আসলে, প্রকৃতি সবকিছুর মধ্যেই সাম্য বজায় রাখে। এটিই প্রকৃতির ধর্ম।

২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রাদুর্ভাব ঘটে করোনা ভাইরাসের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ভাইরাসটিকে পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2 (সংক্ষেপে, SARS-CoV-2) এবং এর দ্বারা সংক্রমিত রোগটিকে Coronavirus Disease 2019 (সংক্ষেপে, Covid-19) নামকরণ করে। ধারণা করা হয়, উহানের সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিজ্ঞানীদের মতে,এটি বাদুর থেকে এসেছে এবং পরে মানুষকে সংক্রমিত করেছে। ৬ই জুন, ২০২০ পর্যন্ত, এ ভাইরাস শুধু মাত্র বাংলাদেশেই ৬৫,৭৬৯ জন মানুষকে সংক্রমিত করে এবং সারা বিশ্বে সংক্রমিত হয় প্রায় ৬.৬৬ মিলিয়ন মানুষ। বিশ্ব ব্যপি মারা যায়, প্রায় ৩ লক্ষ ৯৬ হাজার জন।

আমাদের চারপাশের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু ও প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য জীব ও জৈব উপাদান ইত্যাদির সামষ্টিক রূপই হলো পরিবেশ । পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের দ্বারাই একজন ব্যক্তি বা প্রাণী এমনকি উদ্ভিদ প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই প্রভাবকসমূহের মধ্যে থাকে প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পারিপার্শ্বিক উপাদানসমূহ। আর জীববৈচিত্র্য (Biodiversity) হল উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ পৃথিবীর গোটা জীবসম্ভার, তাদের অন্তর্গত জীন ও সেগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বাস্তুতন্ত্র। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আগ পর্যন্ত মানুষ ভুলতেই বসেছিল যে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুস্থ্য থাকলেই কেবল এ পৃথিবীতে মানব সভ্যতা টিকে থাকবে। তবে, করোনা ভাইরাস একদিকে যেমন লকডাউনে ঘরবন্দি করেছে মানুষকে ঠিক তেমনি এর প্রভাবে পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপরেও।

করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সারাবিশ্বে কলকারখানাসহ সবকিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছে, জ্বালানি শিল্পের মুখ থুবড়ে পড়েছে।গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে সবচেয়ে বেশি দায়ি করা হয় পরিবহন খাতকে। কিন্তু বিশ্বব্যপি এক যোগে যানবাহন সব বন্ধ থাকায়,বায়ুমন্ডলের এ গ্যাসের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। শুধুমাত্র চীনে, লকডাউনসহ অন্যান্য পদক্ষেপের ফলে কার্বন নির্গমনের হার ২৫ শতাংশ এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমনের হার ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, আনুমানিক দুই মাস ধরে এভাবে চললে পৃথিবীতে সুস্থ পরিবেশের জন্য কমপক্ষে ৭৭হাজার প্রাণ রক্ষা পাবে।

করোনা শুধু বায়ুমন্ডলের উন্নতিই করেনি,জীববৈচিত্র‍্যেও এনে দিয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। মাছের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপি মাছ ধরার প্রবণতা হ্রাস পেয়ছে। জার্মান বিজ্ঞানী রেনার ফ্রোনস বলেন, মাছ ধরার তীব্র পতনের কারণে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং ইউরোপীয় জলে কিছু মাছ তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে পারে। লোকেরা লকডাউন ও ভ্রমণ বিধিনিষেধের কারণে বাড়িতে থাকে, ফলে কিছু প্রাণী বন থেকে শহরে চলে আসছে। বঙ্গপসাগরের কচ্ছপগুলো সৈকতে ডিম পাড়তে ছুটে এসেছে। মানুষের বিচরণ না থাকায় বিশ্বব্যাপী সমুদ্র সৈকতগুলোতে অবাধ ঘুরে বেড়াচ্ছে লাল কাঁকড়ার দল। অন্যদিকে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে সাগরলতা। এরমধ্যে একদম লোকালয়ের কাছে এসেই ডিগবাজিতে মেতেছে একদল ডলফিন। প্রকৃতির রাজ্যে এমন পরিবর্তন ইতিবাচকভাবে দেখছেন পরিবেশবিদেরা।

প্রাণীকুলের মধ্যে নিজেদের সবচেয়ে বিচক্ষণ ও পণ্ডিত দাবি করা মানুষই খলনায়কের ভূমিকায় পৃথিবীতে নিজেকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছে। আর সেজন্যই বোধহয় প্রকৃতি আজ মানুষের সাথে নেই। লক্ষ কোটি প্রাণীর বসবাস এই পৃথিবীতে। আর তাদের শাসক হয়ে বসেছে মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে, ১৮০০ সালে গোটা পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল এক বিলিয়ন। ১৯৬০ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ বিলিয়ন। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭ বিলিয়নেরও বেশি। মানুষ প্রকৃতি অংশ হয়ে,প্রকৃতিকেই ধ্বংস করছে। নির্বিচারে গাছ কাটছে,একের পর এক বন ও বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত করে ফেলছে।আর সেজন্যই প্রকৃতি মানুষকে করোনার মাধ্যমে আবারও মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে মানুষের অসহায়ত্ব। বিজ্ঞানীরা পারছেনা কোন ঔষধ বা প্রতিরোধ করার মতো কোন টিকা আবিষ্কার করতে।

মানুষ বা জীবের শরীরে থাকে ইমিউন সিস্টেম। এর কাজ হলো রোগ প্রতিরোধ করা। হয়তো পৃথিবী নামক গ্রহেরও এমন কোনো সিস্টেম আছে, হয়তো করোনাই সেই সিটেমের কোনো এন্টিবডি। মানুষ নামক প্যাথোজেনের অত্যাচারে যখন পৃথিবী পৃষ্ঠ ধ্বংসের সর্বশেষ স্তরে ,তখন এই এন্টিবডির আর্বিভাবে হয়েছে পৃথিবী এবং এর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করতে। হয়তো প্রকৃতি আমাদের বৃহত্তর ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে ক্ষুদ্রতর ক্ষতি করে শিক্ষা দিতে চায়। কারণ প্রকৃতিকে রক্ষা করলে রক্ষাপাবে মানুষ। মানুষ যে প্রকৃতিরই অংশ।

অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় তথা সুস্থতার সঙ্গে জীবন ধারণের জন্যই প্রয়োজন সুস্থ্য পরিবেশ ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের। মানুষসহ সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য একান্ত অপরিহার্য। আর এই ভারসাম্য বজায় রাখতে সঠিক সংখ্যায় সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনের স্বার্থে জীববৈচিত্র্যে রক্ষা করা আবশ্যক। তা না হলে, করোনার মতোই এমন নতুন নতুন রোগ বা দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে বিশ্ব জাতি ভবিষ্যতে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সুস্থ্য পরিবেশ ও সমৃদ্ধ জীব বৈচিত্র‍্যই পারে পৃথিবীকে রোগ-বালাইসহ সকল ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা করতে।

Sources:
(1)https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/technical-guidance/naming-the-coronavirus-disease-(covid-2019)-and-the-virus-that-causes-it (2)https://time.com/5834097/coronavirus-origin-bats-infect-cats-who/
(3)https://news.google.com/covid19/map?hl=en-US&gl=US&ceid=US:en
(4)https://en.m.wikipedia.org/wiki/Biodiversity
(5)https://en.m.wikipedia.org/wiki/Natural_environment
(6)https://en.m.wikipedia.org/wiki/Impact_of_the_COVID-19_pandemic_on_the_environment

আমার আরও কিছু লিখাঃ

০১. ভুতের গাছ ছাতিম
০২. ল্যান্টেনা ফুল || প্রজাপতিরা যে ফুলে নেচে বেড়ায়
০৩. হিজল গাছ || এমনই-হিজল-বট-তমালের নীল ছায়ায় বাংলার অপরুপ রুপ

বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-১)

বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-২)

বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ জগৎ (পর্ব-৩)


পৃথিবীতে কত প্রজাতির উদ্ভিদ আছে? জেনেছেন বিজ্ঞানীরা

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here