অলিভকুঞ্জে হা হা ক’রে হাওয়া কেঁদেছে কাতর যামিনী ভরি!
ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে ‘মার্টিল’ পাতা পড়েছে ‘ঝরি’!
‘উইলো’র বন উঠেছে ফুঁপায়ে, – ‘ইউ’তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে,
তরুণীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে!
(চাঁদিনীতে : ঝরা পালক – জীবনানন্দ দাশ)

তীর দিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে হলে দরকার শক্তপোক্ত ধনুক। বাতার ভেতরের দুই-তৃতীয়াংশ সারকাঠ আর বাইরের এক-তৃতীয়াংশ নমনীয় রসকাঠ হলেই সেই ধনুক পর্যাপ্ত শক্তি পায়। সারকাঠের দাঢ্যতায় তীরের গতি বৃদ্ধি পায়, আবার রসকাঠের নমনীয়তার কারণে খুব বেশি টানলেও ধনুকটি ভেঙে যায় না। সারকাঠের দাঢ্যতা প্রবল আবার সংলগ্ন রসকাঠ খুব নমনীয় – এমন গাছ খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। এ কারণেই অ্যাশ, কেরিতুমড়ি, খোরসান, ভুতিবাদাম, ইউ, স্বর্ণমালা – এমন গাছগুলো দিয়েই যুদ্ধের ধনুক তৈরি হয়। কখনও কখনও লাল ওক, কাবাসি, মিঠা ম্যাপল, চিলবিল, পেকান আখরোট গাছ থেকেও ধনুক তৈরি হয়, কিন্তু তা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়। বিলাতি মাকলুর বা লালতুঁতও ধনুকের কাঠ হিশেবে জনপ্রিয়। তবে এগুলোর রসকাঠ একদম ফেলে দিতে হয়, কারণ সারকাঠের দাঢ্যতা থাকলেও এদের রসকাঠ দীর্ঘস্থায়ী না। ভালো কাঠের আকালে ধনুকের ভেতরের দিকে আখরোট বা কাবাসির সারকাঠ ও বাইরের দিকে অন্য কোন নমনীয় কাঠও ব্যবহার করা হয়।

১৬ শতকে বন্দুক উদ্ভাবনের পূর্ব পর্যন্ত একজন সৈনিকের কাছে তীর-ধনুকই ছিল সবথেকে জরুরি শস্ত্র। শক্তিশালী ধনুক যুদ্ধের গতিমুখই পাল্টে দিতে পারত। এক্ষেত্রে ইউ বা বিরমির কোনো বিকল্প ছিল না। বিরমি কাঠের ছয়ফুটি ধনুক দিয়ে লোহার তীর ছুঁড়ে ১০০ মিটার দূরের ধাতব বর্ম এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলা যায় আর ২০০ মিটার দূর থেকে শত্রুকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করা সম্ভব। রোমান কবি ভার্জিল ও দার্শনিক প্লিনি তাঁদের লেখায় বিরমি কাঠের তৈরি ধনুক ও তীরে বিরমির বিষ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। এর লাল সারকাঠ ও কমলা-বাদামি রসকাঠের সংমিশ্রণে তৈরি ধনুক ছিল তখনকার সৈনিকদের মর্যাদা ও শক্তির প্রতীক। স্কটল্যান্ডের ডামফ্রিজে বিরমির বাতা দিয়ে তৈরি এমন একটি ধনুক পাওয়া গেছে যা খ্রিস্টের জন্মেরও ৩ হাজার ৬০০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল।

স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবাদপুরুষ রবার্ট ব্রুস ১৩১৪ সালে ইংল্যন্ডের সম্রাট দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের বিরুদ্ধে অষ্টম বারের মতো যুদ্ধ ঘোষণা করেন। জনশ্রুতি আছে, স্কটল্যান্ডের পুরোহিতরা পবিত্র আর্চাটন মঠের বিরমি গাছের ধনুক তুলে দেন ব্রুসের হাতে। এ যুদ্ধে ব্রুস জয়লাভ করেন এবং ইংলন্ডেশ্বর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচেন। স্কটল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয় ইংল্যন্ডও। ১৩৩৭ থেকে চলা শতবর্ষী লড়াইয়ের শেষদিকে ১৪১৫ সালে এজিনকোর্টের যুদ্ধে ইংল্যন্ডের সৈন্যরা বিরমির ধনুক ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো জয়ের দেখা পায়। কামানবাহী অপরাজেয় ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের পর বিরমির ধনুক তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। ফলে কাটা পড়ে বিপুল সংখ্যক শতবর্ষী গাছ। বিরমি গাছ সাধারণত বাঁকা হয় এবং কাণ্ডে গাঁট থাকে। তাই বাছাই করা খাড়া গাছ থেকেই শুধুমাত্র ধনুক তৈরি করা সম্ভব হত।

এছাড়া পৃথিবীর সবথেকে ধীরগতিতে বৃদ্ধি পাওয়া দশটি গাছের মধ্যে বিরমি একটি, যা গড়ে বছরে ৪-৬ সেমি বাড়ে। ভালো ধনুকের উপযোগী বাতা সংগ্রহ করতে হলে একটি বিরমি গাছের বয়স হতে হয় ৮০-১০০ বছর। নির্বিচার কর্তনের ফলে দ্রুতই ফর্সা হয়ে যেতে শুরু করে ইংল্যন্ডের প্রাকৃতিক বিরমি বন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজা চতুর্থ হেনরি নতুন এক ডিক্রি জারি করেন যাতে সৈন্যরা অনুমতি ছাড়াই সাধারণ নাগরিকদের বাগান থেকে বিরমি গাছ কেটে আনতে পারে। এতেও চাহিদা পূরণ না হওয়ায় ব্যাপক হারে বিরমির বাতা আমদানি শুরু হয়। আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের ৫১টি দেশ বিরমির আবাসভূমি হলেও ভূমধ্যসাগরীয় শীতপ্রধান অঞ্চলে সবথেকে বেশি জন্মায়।

ইংল্যন্ডের সারে কাউন্টিতে একটি ভগ্ন দেয়াল গুড়িয়ে দিয়ে উঠে গেছে বিরমি গাছ। ছবি : Kew Science

সবথেকে বেশি বিরমি উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো অস্ট্রিয়া, ইংল্যন্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড ও স্পেন। সুতরাং এই ৯টি দেশের মধ্য থেকেই বিরমি আমদানি করা বিধেয়। কিন্তু ১৪২৩ সালে পোল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় ভ্লাদিস্লাভ বিরমি গাছ কর্তন ও রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। অন্যান্য দেশও তাঁকে অনুসরণ করতে শুরু করে দেয়। ফলে ইংল্যন্ডে ধনুকের চরম ঘাটতি দেখা দেয়। এ সময় চার্চের পরামর্শ উপেক্ষা করে রোমান সম্রাট বিরমির বাতা রপ্তানি অব্যাহত রাখেন। কিন্তু তাতেও কুলাচ্ছে না দেখে সম্রাট এক আদেশে ইংল্যন্ডের বন্দর ব্যবহারকারী জাহাজের প্রতিটন পণ্যের জন্য চারটি বিরমির বাতা জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেন। পরবর্তী সম্রাট তৃতীয় রিচার্ড প্রতিটনে চারটি থেকে দশটি করেন। এদিকে ব্যাপক হারে কর্তন ও রপ্তানির ফলে ১৭ শতকের মধ্যে পুরো ব্যাভারিয়া বিরমিশূন্য হয়ে যায়। এরপর ব্রিটিশ সম্রাট বাল্টিক অঞ্চল থেকে বিরমির বাতা আমদানির চেষ্টা করেন। কিন্তু ততদিনে ব্যক্তিগত শস্ত্র হিশেবে বন্দুক জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে।

বিরমি গাছ শীতপ্রধান ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের সব ধরনের মাটিতেই জন্মাতে পারে। তবে চুনাপাথর-বহুল পাহাড়ি ভেজা মাটি ও পাতলা অরণ্যে ভালো জন্মায়। তাই ভারতের উত্তর-পুবের শীতপ্রধান পাহাড়ি অঞ্চলেও বিরমি গাছ পাওয়া যায়। জীবনানন্দ দাশ তাঁর রচনায় যে কয়েকটি বিদেশি উদ্ভিদের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে ‘ইউ’ অন্যতম। জীবনানন্দ-গবেষক গোপালচন্দ্র রায় ইউ বলতে ‘সম্ভবত ইউক্যালিপটাস’ গাছ বলে ধারণা করেছেন। কিন্তু ইউ গাছের সঙ্গে ইউক্যালিপটাসের কোনো সম্পর্ক নেই। ইউক্যালিপটাস গাছটি মার্টেসি গোত্রের উদ্ভিদ, অন্যদিকে ইউ গাছটি ট্যাক্সেসি গোত্রের। ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ জোসেফ ডালটন হুকার ১৮৪৮ সালে আসাম ও বঙ্গ অভিযানের সময় জুন মাসে সিকিমের কোশি নদীর অববাহিকায় বিরমি গাছের দেখা পান। আসামের বালিপাড়া ফ্রন্টিয়ার, খাসিয়া পাহাড় (বর্তমানে মেঘালয়ে), মিশমি পাহাড় (বর্তমানে অরুণাচল প্রদেশে) ছাড়াও মণিপুর ও হিমাচল প্রদেশে প্রাকৃতিকভাবেই বিরমি গাছ জন্মায়। হিমালয়ের পাদদেশে বিরমির পাশাপাশি জন্মায় হিমালয়ী ইউগাছও।

মানবসভ্যতার গোড়া থেকেই শিকারের হাতিয়ার ও বাদ্যযন্ত্র বানানোর কাজেও বিরমি গাছ ব্যবহারের প্রচলন চলে আসছে। ইতিহাসবিদ স্যামুয়েল ওয়ারেন ১৯১১ সালে উত্তরপূর্ব লন্ডনে অ্যাসেক্সের প্রস্তরীভূত কাদার ভিতরে প্রাকপ্রস্তর যুগের নমুনা খুঁজতে খুঁজতে একটি বিরমি কাঠের হাতিয়ার পেয়ে যান। ৩৮.৭ সেমি লম্বা এই হাতিয়ারটির কার্বন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটির বয়স প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার বছর। এটিই মানুষের তৈরি প্রাচীনতম কাঠের হাতিয়ার। ২০০৩ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ বার্নিস মলি আয়ারল্যান্ডের উইকলো কাউন্টির গ্রেস্টোন গ্রামের এক জলাবদ্ধ নালা থেকে ২.৮ ইঞ্চি থেকে ১১.৪ ইঞ্চি লম্বা ছয়টি বিরমি কাঠের বাঁশি উদ্ঘাটন করেন যা বড় থেকে ছোট আকারে সাজানো ছিলো। খুবই কুশলী হাতে নলাকার কাঠে ফুটো করে বাঁশিগুলো তৈরি। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের এ বাঁশিগুলো এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত কাঠের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো।

বিরমির বৈজ্ঞানিক নাম ট্যাক্সাস ব্যাক্কাটা। গ্রিক টক্সন থেকে উদ্ভুত হয়েছে লাতিন শব্দ ট্যাক্সাস। টক্সন শব্দটির দুটি অর্থ হয় – বিষ ও ধনুক। আর ব্যাক্কাটা শব্দের অর্থ খুদিজামের মতো রসালো। বৈজ্ঞানিক নামটির বাঙলা অর্থ করলে দাঁড়ায় – এমন গাছ যা বিষাক্ত ও রসালো খুদিজাম-সদৃশ ফল দেয় এবং যা থেকে ধনুক তৈরি করা যায়। গাছটির চরিত্র তার বৈজ্ঞানিক নামটিকে সার্থক করেছে। বীজের চারপাশের লাল রঙের শাঁসটুকু ছাড়া বিরমি গাছের শেকড়-কাণ্ড-শাখা-পাতা-বীজ সবই বিষাক্ত। কোষের ভেতরে থাকা ট্যাক্সিন নামক উপক্ষার এই বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। তবে শেকড়, কাঠ, বাকল বা পাতার চেয়ে বীজ বেশি বিষাক্ত।

ওক বা ম্যাপলের মতো গাছ বছরের নির্দিষ্ট সময় বিষাক্ত থাকলেও বিরমি গাছে বিষ থাকে সারাবছরই, তবে শীতকালে মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পাতা শুকিয়ে ফেললে এর বিষ আরো বাড়ে। তাই শুকনো পাতার সংস্পর্শে এলেও বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা আছে। পাকস্থলি দ্রুত শুষে নেয় বলে বিরমির বিষে পশুপাখি মারা যাবার ঘটনা প্রচুর। অতিরিক্ত ট্যাক্সিন রক্তের সঙ্গে হৃদপিণ্ডে পৌঁছে এর কাজ বন্ধ করে দেয়। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর জন্য ৫০-৮০ গ্রাম বিরমির পাতাই যথেষ্ট। এই ট্যাক্সিন অ্যালকালয়েডের কোন প্রতিষেধক নেই বিধায় বিষক্রিয়া কমানোর জন্য অ্যাট্রোপাইন-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ত্বক ভেদ করে, এমনকি নিশ্বাসের সঙ্গেও এ বিষ শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই বিরমি গাছ ধরার সময় হাতে গ্লভস পরে নেয়া উচিৎ।

বিরমি গাছে ফুল ফুটেছে । ছবি : Aljos Farjon, Kew Science: Plants of the World Online

চমরি গাইয়ের মতো কিছু প্রাণী বিরমি গাছের পাতা খেয়ে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারে। এছাড়া মুনিয়াজাতীয় হ’ফিঞ্চ, সবুজ ফিঞ্চ ও তিতজাতীয় পাখিরা বিরমির বীজ খেয়ে হজম করে ফেলে। ফুল ফোটার ছয় মাস পরে বিরমির ফল পাকে। বীজ বিষাক্ত হলেও বীজের বাইরের লাল রঙের শাঁস ভক্ষণযোগ্য; রসালো ও মিষ্টি। চুটকি, দামা ও ওয়াক্সউইং-জাতীয় পাখিরা বিরমি ফলের শাঁস খায় এবং মলের মাধ্যমে বীজের সম্প্রসারণ ঘটায়। এরপর আরো তিনমাস শুকনো ফল গাছের ডালে ঝুলে থাকে। ফলে, বংশবিস্তারের জন্য বিরমি গাছ দীর্ঘ সময় পায়। কিন্তু বিরমির অঙ্কুরোদ্গমের হার মাত্র ৩-৫ শতাংশ। প্রকৃতিতে যেসব প্রজাতির স্বাভাবিক প্রজনন সম্ভাবনা কম, তাদের প্রজননের উপায়ও বিচিত্র। গাছটির শাখা ঝুলে মাটি স্পর্শ করলে সেখান থেকে আবার শেকড় গজিয়ে নতুন গাছ জন্মায়, ঠিক যেমনটা হয় বটের ঝুরির ক্ষেত্রে। এ কারণে একে পুনর্জন্মেরও প্রতীক মনে করা হয়। এছাড়া বিরমি গাছ, যত বুড়োই হোক না কেন, গোড়া থেকে কেটে ফেললে গুঁড়ি ও তেউড় থেকে প্ররোহ বা নতুন চারা গজিয়ে ওঠে। উইলো, জিউলি ও শাল গাছেও এমনটা হয়।

ফলসহ বিরমির একটি শাখা । Aljos Farjon, Kew Science: Plants of the World Online

বর্তমান রাইনল্যান্ড, দক্ষিণ নেদারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ ও পূর্ব বেলজিয়ামের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র গল। তারই একটা আদিবাসীশাসিত রাজ্য এবারোন্স। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার পাশের রাজ্য বেলজিক আক্রমণ করলে এবারোন্স আদিবাসী রাজা কাট্যুভোলকাস বেলজিকের রাজা অ্যাম্বিওরিক্সের সঙ্গে মিলে প্রতিরোধ-যুদ্ধ শুরু করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪ অব্দে বেলজিকের পতন ঘটে। এরপর সিজার এবারোন্স দখলে অগ্রসর হন। এ যুদ্ধেও কাট্যুভোলকাস হেরে যান। রোমানদের হাতে অপমানিত হবার চেয়ে মৃত্যুই গৌরবময় ভেবে তিনি বিরমির বিষপানে আত্মহত্যা করেন। তবে জুলিয়াস সিজার বর্ণনা করেছেন যে, গ্রেপ্তার করে রোমে পাঠানো হবে এই ভয়েই কাট্যুভোলকাস আত্মহত্যা করেন।

রোমান ইতিহাসবিদ লুসিয়াস ফ্লোরাসের রচনা অনুসারে, সম্রাট অগাস্টাসের শাসনকালে দশ বছরব্যাপী যুদ্ধের পর খ্রিস্টপূর্ব ২২ অব্দে রোমান সেনাপতি গেইয়াস ফার্নিয়াস যখন উত্তর স্পেনের ক্যান্টারবেরি অবরুদ্ধ করে স্থানীয় যোদ্ধাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান তখন তাঁদের অনেকেই আত্মসমর্পণ না করে বিরমির বিষপানে আত্মহত্যা করেন। অপর রোমান ধর্মতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ পাউলাস ওরোসিয়াস লিখেছেন যে, রোমান বাহিনী উত্তর-পশ্চিম স্পেনের অস্টারেস রাজ্যের সৈন্যদেরকে খনিশহর লাস-মেডুলাসে অবরুদ্ধ করে ফেলার পর আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে অস্টারেস বাহিনী তা অস্বীকার করে এবং বিরমির বিষপানে আত্মহত্যা করে।

বিরমির ফল ও পাতা। ছবি : Didier Descouens, Wikimedia Commons

বিরমি একটি একলৈঙ্গিক বা ভিন্নবাসী উদ্ভিদ, অর্থাৎ এর একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল জন্মানোর নজির বিরল। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিরমি গাছ লিঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলেছে এমন প্রমাণ উদ্ভিদবিদগণ পেয়েছেন। জুন-জুলাই মাসে প্রচুর পরিমাণে পরাগরেণু পুরুষ বিরমি গাছের ফুল থেকে নিঃসরিত হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। স্ত্রীগাছের পরাগধানি সেই রেণু দিয়ে নিষিক্ত হয়। গাছের অন্যান্য অংশের মতো পরাগরেণুতেও ক্ষারীয় বিষক্রিয়া আছে। এলার্জি সংক্রমণের দিক দিয়ে পুরুষ বিরমির রেণুর মান ১০, যা উদ্ভিদ-এলার্জি স্কেল ওপালস-এর মাপকাঠি অনুসারে সর্বোচ্চ। স্ত্রী বিরমির রেণুতেও এলার্জি হয়, তবে তার মাত্রা মাত্র ১ বা সর্বনিম্ন। দেবদারু, সরল ও সাইকাসের মতো বিরমিও নগ্নবীজী উদ্ভিদ। বীজটি আবৃত করে রাখে এর লাল শাঁস যা আসলে স্ফীত ডিম্বকনাড়ি। আমাদের অতি পরিচিত রসালো ফল লিচু ও জয়ত্রীর শাঁসও আসলে বীজের রসালো ত্বক নয়, স্ফীত ডিম্বকনাড়ি।

সাধারণ একটি বিরমি গাছ ৪০০ থেকে ৬০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে, তবে এর প্রায় দশগুণ কাল জীবিত থাকার উদাহরণও আছে। ধারণা করা হয়, উত্তর ওয়েলসের ডেফিলগ গ্রামের সেন্ট সাইনগ চার্চের চত্বরের বিরমি গাছটির বয়স মোটামুটি ৫,০৬৫ বছর। কারো কারো মতে এ গাছের বয়স ২,৫০০ বছরের বেশি নয়। তবে প্রথম গণনা সঠিক ধরে নিলে সবথেকে পুরোনো মিশরীয় পিরামিড নির্মাণেরও ৫০০ বছর আগে বিরমি গাছটির জন্ম এবং মানবসভ্যতার বিবর্তনের এক অনড় সাক্ষী। শুধুমাত্র পাহাড়ি ব্রিস্টলকোন পাইন এর থেকে দীর্ঘজীবী হয়ে থাকে। বিরমি গাছের বয়স যত বাড়ে ততোই এর মাঝখানের সারকাঠ নষ্ট হয়ে খোড়ল তৈরি হয় এবং কাণ্ড ফেটে গাছটির মাথার ভর বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণেই গাছের শাখা-প্রশাখা ও পত্রাচ্ছাদন বা সামিয়ানার ওজনে কাণ্ড ভেঙে পড়ে না। উপকূলীয় রেডউড ও ব্রিস্টলকোন পাইনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। দক্ষিণপূর্ব ইংল্যন্ডের ক্রোহার্স্টের ৪ হাজার বয়সী একটি বিরমি গাছের কাণ্ডের ঘেরের মাপ প্রায় ১০ মিটার এবং আঠারো শতকে এর খোড়লের মুখে কবজাসহ একটি দরজাও লাগানো হয় যাতে এর ভেতরে সমবেত হওয়া যায়।

ইংল্যন্ড, ওয়েলস্‌, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডি এলাকায় চার্চের চত্বরে ও কবরখানায় বিরমি গাছ লাগানো চল আছে। এজন্যেই এর আরেক নাম ‘গোরস্থানের অভিভাবক’। চার্চ ও কবরখানায় বিরমি গাছ লাগানোর এ চর্চাটি প্যাগান সংস্কৃতি থেকে এসেছে। প্যাগান বিশ্বাস অনুযায়ী, বিরমি গৌরবময় মৃত্যুর প্রতীক। গ্রীক, মিশরীয় ও রোমান সভ্যতায়ও বিরমিকে মৃত্যুর প্রতীক বিধায় উপাসনালয়ে ও কবরস্থানে এ গাছ লাগানো হতো। বিরমির শাখা ও পাতায় বিষ থাকার কারণে গরু-ছাগলসহ অন্যান্য প্রাণী গীর্জা ও কবরখানায় ঢোকে না। ষষ্ঠ শতকে পোপ প্রথম গ্রেগরি ব্রিটেনের প্যাগানদের খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করার জন্য সেন্ট অগাস্টিনকে পাঠান। তিনি প্যাগান উপাসনালয়ের স্থানে সুন্দর নকশার গীর্জা নির্মাণের নির্দেশ দিলেও চত্বরের বিরমি গাছ কাটতে মানা করেন যাতে প্যাগানদের মনে ক্ষুব্ধতা তৈরি না হয়। এ কারণেই গীর্জা ও মঠের চত্বরে গাছগুলো রয়ে যায়। অস্ট্রিয়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুযায়ী বিরমি গাছ নিজ ভূমি, মানুষ, পূর্বপুরুষ ও প্রথাগত বিশ্বাসের প্রতীক। অস্ট্রিয়ায় পয়লা নভেম্বরের অল সেইন্ট দিবসে মৃত ব্যক্তির কবরে বিরমির শাখা হাতে নিয়ে প্রার্থনা করা হয় যাতে মৃতব্যক্তি ছায়াময় শান্তিময় নিজভূমে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারেন।

ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ায় এই ভূখণ্ডে অনিয়মিত হালকা মাত্রার বৃষ্টি হয়। ফলে সামাজিক অনুষ্ঠানে সমবেত হবার জন্য সারা বছরই আচ্ছাদনের প্রয়োজন। বিরমির বিস্তৃত ও ঘন সামিয়ানার কারণে এর তলায় অনেক মানুষ সমবেত হতে পারে। এ কারণে ইউরোপীয় পুরোনো গ্রামগুলোর মাঝখানের বারোয়ারি স্থানেও বিরমি গাছ দেখা যায়। আয়ারল্যান্ড ও উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের সন্ন্যাসীরা বড় গীর্জা ও আশ্রমের চত্বরের মাঝ বরাবর বিরমি গাছ লাগাতেন যাতে এর ছায়ায় ভবিষ্যতের শ্রমণগণ পাঠ নিতে পারেন। এরকম কয়েকটি প্রাচীন গাছের গুঁড়ির ঘের প্রায় ১৩ মিটার যার মধ্যে অনায়াসে ৪০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। ৫-৬ মিটার ব্যাসের একটি বিরমি গাছের সামিয়ানার ব্যাস প্রায় ৩০ মিটার যার তলায় অন্তত ১০০ জন মানুষের সমাবেশ করা যায়। তবে সামিয়ানার বিচারে আমাদের কাঁঠালি বট বা ঝুরিবট পৃথিবীর সবথেকে বড় উদ্ভিদ। এরপর ধারাবাহিকভাবে আছে অস্ট্রেলিয়ান ইউক্যালিপটাস, ওরিয়েন্টাল প্লেইন, মেঘশিরীষ ও শ্বেতশিমুল। তালিকার ষষ্ঠ গাছটি বিরমি বা ইউগাছ।

উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘দ্য ইউ ট্রি’ কবিতায় ইংল্যন্ডের লরটন গ্রামের ভাঁটিখানার পেছনে নির্জন চত্বরে একাকী দাঁড়ানো বিরমি গাছের বিষাদগাথায় যুদ্ধ ও মৃত্যুর সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে –  

There is a Yew-tree, pride of Lorton Vale,
Which to this day stands single, in the midst
Of its own darkness, as it stood of yore:
Not loathe to furnish weapons for the Bands…

উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর রচনাবলিতে সাতবার বিরমি গাছের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর কাব্যে বিরমি গাছ বিষ ও মৃত্যুর পাশাপশি হয়ে উঠেছে শোকের প্রতীক। টুয়েলফ্‌থ নাইট, দ্বিতীয় রিচার্ড, টাইটাস অ্যান্ড্রেনিকাস, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট ও ম্যাকবেথ গ্রন্থে বিরমির উল্লেখ আছে। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট কাব্যনাট্যে জুলিয়েটের পাণিপ্রার্থী কাউন্ট প্যারিস এবং রোমিও’র বিশ্বস্ত চাকর বালথ্যাজার দু’জনের মুখেই বিষের প্রতীক হিশেবে বিরমি গাছের কথা শোনা যায়। রোমিও’র মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ভিক্ষু লরেন্সকে বালথ্যাজার বলছে –

As I did slept under this Yew tree here,
I dreamt my master and another fought,
And that my master slew him.

টি.এস. এলিয়টের কাব্যে বিরমি গাছ মৃত্যু বা সমাপ্তির প্রতিচ্ছবি হিশেবে বিধৃত। তাঁর ‘ফোর কোয়ার্টার্স’ কাব্যগ্রন্থের ‘বার্ন্ট নরটন’ ও ‘লিটল গিডিং’ কবিতায় একাধিকবার এ গাছের কথা লেখা হয়েছে। লিটল গিডলিং কবিতার পঞ্চম সর্গে এলিয়ট বলছেন –

The moment of the rose and the moment of the yew-tree
Are of equal duration. A people without history
Is not redeemed from time, for history is a pattern
Of timeless moments. So, while the light fails
On a winter’s afternoon, in a secluded chapel
History is now and England.

জীবনানন্দ দাশ হয়তো ইউ গাছের নাম শুনেছেন তাঁর কাকা উদ্ভিদবিদ অতুলানন্দের মুখে। আবার উইলিয়াম শেক্সপিয়র, টি.এস. এলিয়ট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ – এঁরা তাঁর প্রিয় কবিদের অন্যতম। এঁদের রচনা থেকেও তিনি পেতে পারেন ইউ গাছের ধারণা। প্যাগান সংস্কৃতি সম্পর্কেও যে তিনি জানতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘আজ’ কবিতায়। প্রাচীন গৌরবময় সভ্যতার মতোই যে প্রণয় লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ তারই প্রতীক হিশেবে তিনি কি বিরমি গাছের শাখা ভেঙে যাবার কথা বলেছেন? হয়তো তাঁর মনে পড়েছিলো অস্ট্রীয় ঐতিহ্যের কথা যেখানে বিগত মানুষের স্মরণে বিরমি গাছের ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে গ্রামবাসী যাত্রা করতো কবরখানার দিকে। তখন ভাঙা সেই ডাল হয়ে ওঠে বিগত স্মৃতির শোকগাথা। অথবা তাঁর মনে পড়েছিলো, আইরিশ লোকগাথা যেখানে পবিত্র বিরমির ডাল ভেঙে গেলে পুর্ণিমার চাঁদ সহসা অমাবশ্যার দিকে ধাবিত হয়, যা আসলে মৃত্যুরই নামান্তর!

গ্রিক পুরাণ অনুসারে বিরমি গাছ জাদুবিদ্যা, অন্ধকার ও ভেষজবিদ্যার দেবী হেকেটের সহচর। হেকেটের হাতের বিরমি গাছের স্পর্শে নরকযন্ত্রণাদগ্ধ রোগী স্বর্গীয় অনুভূতি পেতো। ফলে, ধারণা করা যায় যে, প্রাচীনকালে গ্রিসে জটিল রোগের চিকিৎসায় বিরমি গাছ ব্যবহার করা হতো। ভারতীয় উপমহাদেশেও বৈদিক যুগ থেকে ভেষজ ওষুধ হিশেবে বিরমির ব্যবহার ছিল। বিরমি গাছের পাতা থেকে পাওয়া যায় উদ্বায়ী তেল, ট্যানিক এসিড ও গ্যালিক এসিড যা আয়ুর্বেদ অনুসারে মেধা ও রুচি বাড়ায়; জ্বর, কুষ্ঠ ও চর্মরোগ নিরাময় করে এবং দুশ্চিন্তা, জ্বালাপোড়া ও জীবাণু-সংক্রমণ দূর করে। চরকসংহিতায় চার ধরনের ওষুধ তৈরিতে এ গাছ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আয়র্বেদশাস্ত্রে এ গাছের নাম বরহিবরহা, শুকবরহা, শুকপুষ্প, শুকচূড়া ও কুক্কুরা।

আধুনিক আয়ুর্বেদ অনুসারে অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, হেঁচকি, অজীর্ণ, বাতরোগ ও মৃগীরোগের চিকিৎসায় বিরমির পাতা ব্যবহার করা হয়। মুত্রথলির জ্বালাপোড়া, ব্রন, মাথাব্যথা, বাতজ্বর এবং হৃদপিণ্ড ও বৃক্ক সংক্রান্ত রোগের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় অঙ্কুর, কচি কাণ্ড ও ফলের শাঁস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি ব্রঙ্কাইটিস ও ওষুধ-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় বিরমি ফলের শাঁস কার্যকর ওষুধ। ইউনানি-মতে মাথাঘোরা ও মাথাব্যথা, অনিয়মিত হৃদকম্পনজনিত দুর্বলতা, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা, পানিশূন্যতা, যৌন-দুর্বলতা ও অজীর্ণ রোগের চিকিৎসায় বিরমি গাছের নবাঙ্কুরের আরক কার্যকর ওষুধ। তবে বিরমির যে কোনো ওষুধ পরিমিত মাত্রায় ও শুধুমাত্র অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিৎ। আয়ুর্বেদ অনুসারে, রোগের ধরন বিবেচনায়, দৈনিক ১-৩ গ্রাম বিরমির পাউডার সেবন নিরাপদ। অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে বিষক্রিয়ায় জীবনহানির আশঙ্কা আছে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় এর ব্যবহারের পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।

ট্যাক্সল দিয়ে ক্যান্সারের কেমোথেরাপি চলছে। ছবি : Oncology News, Australia

পারস্যের বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক ইবনে সিনা তাঁর আল-কানুন ফি-আলতিব (চিকিৎসা বিষয়ক বিধানাবলি) গ্রন্থে হৃদপিণ্ডের চিকিৎসায় বিরমির নির্যাস ব্যবহারের পদ্ধতি বর্ণনা করেন। কিন্তু গত শতকের ছয়ের দশকের পূর্ব পর্যন্ত পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিদগণ এ ধারণা গ্রহণ করেননি। ১৯৬৭ সালে ভারতীয় বংশোদ্ভূত চিকিৎসাবিজ্ঞানী মনসুখ সি. বাণী ও মার্কিন কেমিস্ট মনরো এলিয়ট ওয়াল যৌথভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইউ গাছের বাকলের নির্যাস থেকে প্যাক্লিট্যাক্সেল নামক রাসায়নিক আহরণ করেন, যা ক্যান্সার রোগ নিরাময়ে কোটি কোটি যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের কাছে আশীর্বাদ হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্যাক্লিট্যাক্সেল বাজারে ট্যাক্সল নামে পরিচিত। কেমোথেরাপি দেয়ার সময় ধমনিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করতে হয়। ট্যাক্সল কোষের ক্যান্সার-সংক্রমণ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে জানা যায় যে, বিরমি গাছে তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে ট্যাক্সল পাওয়া যায়। এরপর থেকে এই দুই ধরনের গাছের উপরই নৃশংস কুড়াল নেমে আসে।

দুনিয়াজুড়ে প্রতি বছর ৮শ’ থেকে ১ হাজার কেজি ট্যাক্সলের চাহিদা রয়েছে যা প্রতি বছর বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। প্রতিকেজি ট্যাক্সলের জন্য দরকার ৩০ টন বিরমি গাছ। পর্যাপ্ত ট্যাক্সল উৎপাদনের জন্য বৈধ ও অবৈধভাবে প্রতি বছর প্রাকৃতিক বন থেকে বিরমি গাছ কেটে ২৪ থেকে ৩০ হাজার টন কাঠ, বাকল ও পাতা সংগ্রহ করা হয়, যেখানে মাত্র ৬ হাজার টন কাঠ সংগ্রহ করা নিরাপদ। কিন্তু চাহিদা ও জোগানের টানাপোড়েনে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গোপন ও প্রকাশ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র দিল্লি, কলকাতা, ও গুয়াহাটি শহরে দেড়শ’রও বেশি বিরমি সংগ্রহ ও রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান আছে। কাঠচোরেরা মেঘালয়, অরুণাচল ও মণিপুরের আদিবাসীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে বন থেকে ব্যাপক হারে গাছ কেটে নিয়ে যাবার ফলে ১৯১০ সালের তুলনায় মাত্র ৯ শতাংশ বিরমি গাছ টিকে আছে। ২০০১ সালে আসামে চোরাই বিরমির একটি চালান আটকের পর জানা যায় যে, রাজনীতিক ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে এ কাজে বন সংরক্ষণকারীরাও জড়িত। এমন স্বার্থজোটের কারণেই সারা পৃথিবীর বিরমি গাছ দ্রুত উজাড় হয়ে যাচ্ছে।

১৯৯২ সালে সাবেক মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি ও নোবেল বিজয়ী পরিবেশকর্মী আল গোর ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্যাপকভাবে বিরমি গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি লেখেন, “ধন্বন্তরি রাসায়নিক ট্যাক্সল আহরণের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিরমি গাছ কাটা হচ্ছে। ফুসফুস, স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের চিকিৎসায় এ ওষুধ ব্যবহার না করলে হয়তো প্রচুর রোগীর নির্মম মৃত্যু হবে। তাই বিরমি গাছ কাটার ঘটনা আমাদের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক। কিন্তু যখন আমরা জানি যে, প্রতিটি ক্যান্সারের রোগীর চিকিৎসায় তিনটি করে পূর্ণবয়স্ক গাছ কেটে ফেলা হয়, তখন ঘটনা আর স্বস্তিদায়ক থাকে না”। এর পরপরই বিশ্বব্যাপী বিরমি গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, ভারত, ভুটান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বহু দেশে বিরমি গাছ সংরক্ষিত উদ্ভিদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এবং অনুমতি ছাড়া গাছ কাটলে কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

এরই মধ্যে ১৯৮৬ সালে ইউরোপীয় ইউগাছের পাতার নির্যাসের সঙ্গে কৃত্রিম রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি করা হয় আধাকৃত্রিম ডোসিট্যাক্সেল। ১৯৯৫ সাল থেকে এটি পাকস্থলি, স্তন, মাথা-ঘাড়, প্রোস্টেট ও ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইদানিং ভুতিবাদাম ও হ্যাজলনাটের বাকল থেকেও ডোসিটাক্সেল তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ট্যাক্সলের তুলনায় ডোসিট্যাক্সেলের দাম খুব বেশি। উন্নয়নশীল দেশের বাজারে ১০০ মিগ্রা ট্যাক্সলের যেখানে দাম ৬০০-১১৫০ টাকা সেখানে একই পরিমাণ ডোসিট্যাক্সেলের দাম ১৭০০-৭৫০০ টাকা। দামের এই পার্থক্যের কারণে ট্যাক্সল এখনও বহুল ব্যবহৃত ওষুধ।

ট্যাক্সলের ব্যাপক চাহিদার কারণেই বিরমি চাষ একটি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। মেঘালয় ও অরুণাচল সরকারের উদ্যোগে ব্যক্তিপর্যায়ে বিরমি গাছের চাষ শুরু হয়েছে। ভারতীয় বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে বিরমির পুনর্বনায়নও হচ্ছে। সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মিরের শীতপ্রধান এলাকায় কাটিং পদ্ধতিতে বিরমি চাষের চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব কারণে ২০১৭ সালে আইইউসিএন বিপন্ন প্রাণের তালিকায় ইউগাছকে ‘সংশয়হীন’ তালিকায় রেখেছে।

কিন্তু বিরমি গাছ থেকে ভাল মানের ট্যাক্সল সংগ্রহ করতে হলে গাছটির বয়স কমপক্ষে ২০ বছর হতে হয়। ব্যক্তিগত জমি এত বছর ধরে উৎপাদনহীন রাখার মতো কৃষক দক্ষিণ এশীয় দারিদ্র্যে বিরল। এ কারণে যেসব বনাঞ্চল দুর্গম ও নজরদারির ব্যবস্থা দুর্বল, সেখান থেকে বিরমি গাছ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৬ সালে প্রাকৃতিক বন থেকে বিরমি গাছ সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেয়। বিরমি গাছের উপযোগী শীতপ্রধান এলাকাগুলোতে ব্যাপক হারে পুনর্বনায়ন এবং নিজাবাস ও বহিরাবাস সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে এই মূল্যবান উদ্ভিদটি পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে।

মাঝারি বৃক্ষ, বহুবর্ষী, চিরসবুজ, ব্যক্তবীজী। উচ্চতা ১০-২০ মিটার, সর্বোচ্চ ২৮ মিটার; বাকল লালচে ধূসর বা লালচে বাদামি। পাতার রঙ উপরে গাঢ় সবুজ, তলার দিকে হলদে সবুজ। পাতা দ্বিপক্ষল, রেখাকার ও সরু; লম্বায় ১-৪ সেমি ও চওড়া ২-৩ মিমি। ফুল পাতার গোড়া থেকে জন্মায়; পুরুষ ফুল বর্তুলাকার, রঙ হলুদ; স্ত্রী ফুল খাড়া ও সবুজ। ফুল ফোটার সময় বসন্তকাল, মার্চ – জুলাই। ফল (বীজত্বক) ডিম্বাকার; ৮-১৫ মিমি লম্বা, নিচের দিকে খোলা; কাঁচা অবস্থায় সবুজ ও পাকলে লাল।

বাঙলা নাম : ইউ, বিরমি, ভিরমি, সুগন্ধা, তালিশপত্র | ইংরেজি নাম : Yew, Common Yew, European Yew, English Yew | অন্যান্য নাম : তেসিয়াং (অরুণাচল), শুকপুষ্প (আয়ুর্বেদ), শুকচূড়া (আয়ুর্বেদ), জর্নব (উর্দু), স্থৌনেয়াক (কান্নাড়া), বার্মি (মারাঠি), বার্মাপাল্লা (নেপালি), থালিশপত্র (নেপালি), গ্রন্থিপর্ণ (সংস্কৃত), মাণ্ডুপর্ণী (সংস্কৃত), তালিসপত্র (সংস্কৃত), গাল্লু (হিন্দি), থুনো (হিন্দি) | বৈজ্ঞানিক নাম : Taxus baccata L. | প্রচলিত সমনাম : Cephalotaxus adpressa Beissn. | গোত্র : Taxaceae

বিস্তৃতি : অস্ট্রিয়া, আজারবাইজান, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আলজেরিয়া, আলবেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, ইউক্রেন, ইতালি, ইরান, এস্তোনিয়া, গ্রিস, চিন, চেক রিপাবলিক, জর্জিয়া, জাপান, জার্মানি, জিব্রালটর, ডেনমার্ক, তুরস্ক, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, বার্মা (মিয়ানমার), বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ভারত, ভুটান, মন্টেনেগ্রো, মরক্কো, মালদোভা, মাল্টা, মোনাকো, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, রোমানিয়া, লাটভিয়া, লিচটেন্সটেইন, লুক্সেমবার্গ, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, স্পেন, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি

সংশ্লিষ্ট উদ্ভিদ : অস্ট্রেলীয় ইউক্যালিপ্টাস : Eucalyptus microtheca F.Muell. | উপকূলীয় রেডউড : Sequoia sempervirens (D.Don) Endl. | ওরিয়েন্টাল প্লেইন : Platanus orientalis L. | কাবাসি : Acer campbellii Hook.f. & Thomson ex Hiern | কেরিতুমড়ি : Pittosporum kerrii W.G. Craib | খোরসান : Pittosporum napaulense (DC.) Rehder & E.H. Wilson | চিলবিল : Holoptelea integrifolia Planch. | জিগা : Lannea coromandelica (Houtt.) Merr. | পেকান আখরোট : Carya illinoinensis (Wangenh.) K.Koch | প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইউ : Taxus brevifolia Nutt. | বট বা কাঁঠালি বট : Ficus benghalensis L. | বিলাতি মাকলুর : Maclura pomifera (Raf.) Schneid. | ব্রিস্টলকোন পাইন : Pinus longaeva D.K.Bailey | ভুতিবাদাম : Corylus jacquemontii Decne. | মিঠা ম্যাপল : Acer saccharum Marshall | মেঘশিরীষ : Samanea saman (Jacq.) Merr. | লাল ওক : Quercus rubra L. | লালতুঁত : Morus rubra L. | শ্বেতশিমুল : Ceiba pentandra (L.) Gaertn. | স্বর্ণমালা : Laburnum anagyroides Medik. | হ্যাজলনাট : Corylus avellana L. | হিমালয়ী অ্যাশ : Fraxinus floribunda Wall. | হিমালীয় ইউ : Taxus wallichiana Zucc. | হেমলক : Conium maculatum L.

সংশ্লিষ্ট প্রাণী : ওয়াক্সউইং : Bombycilla গণভূক্ত পাখি | চমরি গাই : Bos grunniens Linnaeus | চুটকি : Muscicapidae গোত্রভূক্ত পাখি | তিত (বড়) : Parus major Linnaeus | দামা : Turdidae গোত্রভূক্ত পাখি | মুনিয়া : Lonchura গণভূক্ত পাখি | সবুজ ফিঞ্চ : Chloris chloris Linnaeus | হ’ফিঞ্চ : Coccothraustes coccothraustes Linnaeus

সহায়ক পরিভাষা : আরক : Tincture | উপক্রান্তীয় : Sub-tropical | ওপালস : Ogren Plant Allergy Scale (OPALS) | তেউড়ি ও ধাবকমূল : Sucker | নিজাঙ্গন, নিজাবাস : In-situ | প্ররোহ বা গজ : Coppice | বর্তুলাকার : Globose | বহিরাবাস : Ex-situ | ভিন্নবাসী : Dioecious | রসকাঠ : Sapwood | রেখাকার : Linear | সামিয়ানা বা পত্রাচ্ছাদন : Canopy | সারকাঠ : Heartwood | স্ফীত ডিম্বকনাড়ি : Aril

তথ্যসূত্র : Alloatti et al. (1996). Pp 845-854; আহমেদ ও অন্যান্য (২০০৯ঙ). পৃ ৩৫৩; Kanjilal et al. (1940). p 346; Quattrocchi, U. (2012). p 3679; Khare, C.P. (2007). p 648; Ginsberg, J. (2003). p 3; Gore, A.A. (1992). p 119; গুহ, অরবিন্দ. (২০১৫). পৃ ৭৬; গুহ, ভূমেন্দ্র (২০১৭). পৃ ৯৮; Thomas & Polwart (2003). p 499; দাশ, কুসুমকুমারী (২০১২). পৃ. ১১৫; দাশ, জীবনানন্দ (২০০৬ক). পৃ ১৫৯; দে, সুবিমলচন্দ্র (২০১২). পৃ ২১৩; Dhyani et al. (2014). p 68; Polunin & Stainton (1997). p 391; ফরিদ, জায়েদ (২০১৬). পৃ ১৫০; Bevan-Jones (2004). p 46; Rawat et al. (2011). p 46; রায়, গোপালচন্দ্র (২০১২). পৃ ১৬৬; Lanker et al. (2020). p 20; শর্মা, দ্বিজেন (২০০৪). পৃ ৩২; Sharma et al. (2014). p 472; Caesar, J. (2012). p 32; Harrison & Kirkham (2019). p 58; Hobbs & West (2020). p 15; Hooker, J.D. (1854b). p 45

5 COMMENTS

  1. চমৎকার একটা লিখা, ধন্যবাদ লেখক কে এমন তথ্যবহুল একটি পোস্ট এর জন্য ।আপনার কাছ থেকে আরো লিখা চাই।

    • অনেক অনেক ধন্যবাদ, প্রিয় অ্যাডমিন। আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করছি। জানি না কতোটা লিখতে পারবো। কারণ আলসে মানুষ আমি, আর জানিও একদম কম। দুটো মিলে একটা জিনিসই সৃষ্টি হয় : অনাসৃষ্টি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here